বৃহঃস্পতিবার, ৯ মে ২০২৪
 
vatirrani News

ময়না

খাইরুল ইসলাম | ১:৩০ অপরাহ্ন, ৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮

1517988604.jpg
খাইরুল ইসলাম

ভোর পাঁচটা, সারারাত নির্ঘুম ডিউটি পালন করেও কোন শিকার না পেয়ে ময়না ডাকাত ও তার সতীর্থরা যে যার বাড়ি ফিরে যাচ্ছিল। মসজিদ থেকে ভেসে আসা আযানের সুমধুর ধ্বনি অন্ধকারের বুক ভেদ করে চুতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ছে। সেই সাথে সূর্যের আগমন উপলক্ষ করে আসমান কালো থেকে দূসর বর্ণ ধারণ করতে শুরু করেছে। ময়না তার দলবল বিদায় দিয়ে শার্টের উপর কাল একটা চাদর পেছিয়ে বাড়ি ফিরছিল। এমন সময় তার চোখে পরে একটা পিকআপ তার দিকে এগিয়ে আসছে। তার জ্বিবে পানি চলে আসে। কিন্তু তার সাথে কেউ নেই, নেই কোন অস্ত্র। তবু সে ভ্যানের সামনে গিয়ে দাড়িয়ে ভ্যান আটকায়। মফস্বলের চিকন রাস্তা, তাই আটকাতে সুবিধা হয়।

ভ্যান আটকানোর পর দেখে এটা ফলমূল এবং সবজিতে ভর্তি। ভ্যানে মাত্র দুজন লোক থাকায় ময়না ডাকাত সাহস পেয়ে যায়। তাই সে আড়তদার কে বলে দুটো কলা দিতে। একটা কলা সে মুখে পুরে দেয় এবং ড্রাইভার ও আড়তদারের চোখে চোখ রেখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায়। পাকা পোক্ত ডাকাতির চোখ তাই সে ড্রাইভার ও আড়তদারের দিকে তাকিয়েই বুঝতে পারে এখানে সে কোন অস্ত্র ছাড়াই ডাকাতি করতে পারবে। সে একটা কলা খেয়ে শেষ করে অন্য কলাটা চাদরের তল দিয়ে আড়তদারের পেটে গুজে দিয়ে বলে -

"যা আছে সব দে। নাইলে একটা ফায়ার করমু, তুই এহানেই কাত অইয়া যাবি।"

মধ্যবয়সী আড়তদার ভয়ে কাঁপতে থাকে এবং সে তার কাছে থাকা পঁয়তাল্লিশ হাজার টাকা, ঘড়ি এবং টর্চলাইট ডাকাতের হাতে তুলে দেয়। আর ড্রাইভার বসে বসে প্রার্থনা করতে থাকে কবে সে মুক্তি পাবে, তার বউ বাচ্চার কাছে যাবে।

ড্রাইভার মনে মনে আড়তদার কে গালিও দেয়। আড়তদারের জন্যই আজ এত বড় সর্বনাশ হলো। আর দু ঘন্টা পর রওয়ানা হলে কি হতো? আড়তদার সকালের বাজার ধরার জন্যই মূলত অন্ধকার থাকতেই রওয়ানা হতে বলেছিল ড্রাইভারকে।

সবকিছু কেড়ে নিয়ে ময়না বলে -

"একদম পিছে চাইবি না। সোজা চইলা যাবি। পিছে চাইবি তু ফুট্টুস কইরা দিমু।"

এই বলে সে আড়তদারের ঘাড়ে সজোড়ে চপোড়াঘাত করে। আড়তদার ছাড়া পেয়ে প্রাণপণে দৌড়ে ভ্যানে উঠতেই ড্রাইভার ইঞ্জিন স্টার্ট দিয়ে সোজা চলতে থাকে। আর এদিকে ময়নাও বিপরীত দিকে দৌড়াতে থাকে প্রাণপণে।

ততক্ষণে আবির ছাড়িয়ে কুসুম সদৃশ সূৃর্যের দেখা মেলে। নিরাপদ জায়গায় পৌছে ময়না একা একা হাসতে থাকে।তার হাঁপনিতে হাসির শব্দ স্পষ্ট নয়। সে হাসতে হাসতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। তার হাসি অট্টোহাসিতে পরিণত হয়ে সকালের ঘুমন্ত দিগন্ত কে জাগিয়ে তুলে। সে হাসিতে পাওয়া যায় এক বর্বর আনন্দের আভাস। তারপর টাকার বান্ডেলটা বের করে নতুন কচকচে পাঁচশ টাকা এক হাজার টাকার নোটের ঘ্রাণ শুকতে থাকে। কি বোকা ই না বানাল আড়তদারকে! এই ভেবে সে মুচকি হাসে।কোনভাবেই সে কর্কশ মুখমন্ডল স্বাভাবিক রাখতে পারেনা।হাসিতে মুখ বাঁকা হয়ে উঠে।

এভাবেই একের পর এক হত্যা, গুম, ডাকাতি করে ময়না ডাকাত সবার চোখে ধুলি দিয়ে।কেউ তাকে কিছু বলতে পারেনা। তার দিকে চোখ রেখে কথা বললেই কল্লাফতে। তাই পাড়ার সব লোক তাকে দেখে তটস্হ থাকে।এলাকার মেম্বার, চেয়ারম্যান ও তার বিরুদ্ধে কিছু বলতে সাহস করেনা। বরং তার সাথে খাতির জমাতে ব্যস্ত থাকে।

ময়না তার সাহস এবং কূটবুদ্ধির দ্বারা শুধু এলাকায় নয়, ডাকাতদের মধ্যে ও আধিপত্য বিস্তার করেছে। তাই সে তার এলাকার ডাকাতদের সর্দার।

তার দুই ছেলে এবং স্ত্রীকে নিয়ে সে বেশ রাজকীয় হালেই থাকে। কিন্তু তার জীর্ণ-শীর্ণ ঘরখানা দেখলে তা বোঝা খুব কঠিন। তার ইনকাম প্রচুর কিন্তু এক টাকাও সঞ্চয় থাকেনা। এ নিয়ে মাঝেমধ্যে সে চিন্তা করে কিন্তু কোন উত্তর পায়না। তাই দাদার আমলের দুটো ঘরেই ময়নার ঠাই।

তার বাড়িতে চলে সতীর্থদের নিয়ে রাতভর আড্ডা। মদ, গাঁজা, তাসের আড্ডায় সে ফূর্তিতে মেতে থাকে সারারাত। তার বউ তাকে কিছু বলতে পারেনা। ময়নার সামনে পড়লেই যেন তার বুক দরফর করে উঠে। তাই সে ময়না থেকে নিরাপদ দুরুত্ব বজায় রাখার স্বার্থেই কিছু বলা থেকে বিরত থাকে। সেদিন ময়নার বড় ছেলের জ্বড়ে যায় যায় অবস্হা। কিন্তু ডাক্তার দেখানো হয়নি।তাই অসহায় মায়ের মন আর টিকতে পারেনি। ময়নার আঁতুর ঘরে ঢুকে ময়নার বউ রূপালি তার ছেলেকে ডাক্তার দেখাতে বললে তাকে রড দিয়ে পিটিয়ে জখম করে।পরে তার অজ্ঞান নিস্তেজ দেহ খাটের উপর রেখে আসে মাতাল ময়না।এভাবেই ময়না তার বউয়ের কাছে তার বীরত্বের প্রমাণ দেয় কোন অজুহাত ছাড়াই।রূপালী তার ছেলে মেয়ের মায়া করে ময়নাকে ছেড়েও যেতে পারেনা।এভাবেই বর্বর আনন্দে ময়নার সংসার চলছিল।

মাঘের ১৩ তারিখ,রাত ১২টা, মফস্বল থেকে দূরে একটা জঙ্গলের পাশে ডাকাতি চলছে।শীতেরর এই সময়টাকে ডাকাতির মৌসুম বলা হয়ে থাকে। কারণ কুয়াশায় গুপটি মেরে ডাকাতি করা অনেক সহজ। রাস্তায় গাছ কেটে ময়না ও তার দলবল একটি দূরপাল্লার বাস আটক করে।ময়না বাসের ড্রাইভারের মাথায় পিস্তল ধরে সবাই কে নির্দেশ দিচ্ছিল ডাকাতির। কিছুক্ষণের মধ্যেই কংক্রিট বোঝাই একটা বড় ট্রাক আসছিল। ট্রাকের শব্দ শুনেই ময়না বাস থেকে লাফ দিয়ে নামে ট্রাকেও ডাকাতি করার উদ্দেশ্যে।ট্রাক ও গাছের গোড়া দেখে থামে। কিন্তু ততক্ষণে ময়নাকে পিছন থেকে ধাক্কা মেরে বাতাসের গতিতে ঠেলে দেয়। ময়না রাস্তার পাশে মুখ থুবড়ে পরে গুঙাতে থাকে। তার পাজর এবং কোমরের হাড় ভেঙ্গে যায়। সে উঠে দাড়াতে চেষ্টা করে,কিন্তু তার শক্তিশালী দেহ তাকে দাড় করাতে ব্যর্থ হয়। ততক্ষণে দুজন সতীর্থ এসে তাকে টেনে তুলবার চেষ্টা করে।কান্তু তার নিস্তেজ পা দুটো দাড়াতে অক্ষম।সে চিৎকার করতে থাকে যন্ত্রণায়।ডাকাতি শেষ করে সবাই তার কাছে আসে। টাকা খরচ হবে চিন্তা করে কেউ তাকে হাসপাতালেও নিয়ে যায়নি।বরং ধরা পড়ে যাবে এই ভয়ে তাদের একজন ময়নার গালায় একটা গামছা ঢুকিয়ে দেয়ে জোড় করে।ময়নার নিস্তেজ হাত শত চেষ্টা করে বাধা দিতে কিন্তু তা পারেনা। তাই ময়নার রুক্ষ চোখ দিয়ে প্রতিবাদের অশ্রু প্রবাহিত হতে থাকে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই সব ডাকাত মিলে ময়নাকে ঝোপের গভীরে নিয়ে রেখে আসে।রাত তখন প্রায় চারটা,কিছুক্ষণের মধ্যেই আযান পরবে। সবাই যখন ময়নাকে রেখে আসছিল তখন ময়না ক্রোধে শৈল্পিক গালাগাল দিতে থাকে তার সতীর্থদের। কিন্তু গলার ভিতর গামছা থাকায় কিছুই শোনা যায় না। তাই অনুতাপ অশ্রুতে তার গাল সিক্ত হচ্ছিল।চোখের সামনে ভেসে উঠতে থাকে তার সব অপকর্ম। অনুতাপের আগুন তার বুকের ভিতর দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকে এবং তার রুক্ষ পাষাণ হৃদয়কে মোমের মত গলিয়ে দিতে থাকে। তখন হয়ত সে শেষ বারের মত সৃষ্টিকর্তার নিকট সুযোগ চাচ্ছিল যদি এবার সে মুক্তি পায় তাহলে আর কোনদিন ডাকাতি করবে না। কিন্তু তার সেই অনুতাপ অরণ্যে রোদনে পরিণত হয়। চোখের সামনে ভেসে উঠছিল তার বউ রূপালি এবং ছেলেমেয়েদর ছবি।ততক্ষণে ঝোপের আড়ালে গর্তের মধ্যে লুকিয়ে থাকা তিন চারটা শেয়াল ছুটে আসে এবং তাকে আক্রমণ করে। তার চোখ,কান,নাক,হাত,পা,নাড়িভূড়ি সবই শেয়ালের উদর পূর্তিতে কাজে লাগে। দিনের বেলায় অবশিষ্টাংশ কুকুরের কপালে জুটে। পড়ে থাকা বাকি হাড়লো কাফনের কাপড়ে শোভা পায়।কারণ পাপের টাকায় শরীরের মাংস বৃদ্ধি পায়, হাড় বৃদ্ধি পায় না।

লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সাভিয়ানগর, অষ্টগ্রামের কৃতি ছাত্র।

Post Your Comment

সম্পাদক: গোলাম রসূল, উপদেষ্টা সম্পাদক: কুদ্দুস আফ্রাদ ও ইব্রাহিম খলিল খোকন, নির্বাহী সম্পাদক: এস. এম. ফরহাদ
বার্তাকক্ষ: 01911214995, E-mail: info@vatirrani.com
Developed by CHAHIDA.COM