সোমবার, ২০ মে ২০২৪
 
vatirrani News

শেষ স্বপ্ন

খাইরুল ইসলাম | ১১:৩৯ পূর্বাহ্ন, ৮ জানুয়ারী, ২০১৮

1515389972.jpg
খাইরুল ইসলাম

সুন্দর রৌদ্রকরোজ্জ্বল সকাল। মিষ্টি রোদ আর পাখির কাকলিতে সুন্দরপুর গ্রাম সবসময় মুখরিত থাকে। যেন কোন শিল্পীর নিজহাতে গড়া স্বপ্নপুরী। এই গ্রামেরই একজন বাসিন্দা গফুর মিয়া। দুপুরবেলা তার একমাত্র গাভীর জন্য ঘাস তুলে এনে খেতে দিচ্ছিল।এমন সময় ঘর থেকে ডাক আসে আব্বা, আব্বা। একটা খুশির খবর আছে। এই বলে তার ১২ বছর বয়সী মেয়ে আমিনা তার কাছে আসে।

-তুমি একটা খবর হুনচ নি?

গফুর ইতস্তত বোধ করে কোমড় থেকে গামছাটা কাধে তুলে নিয়ে জিজ্ঞেস করে কি খবররে মা?

-তোমার ছেলে এ পেলাস পেয়ে ইন্টারমেডিয়েট পরীক্ষায় পাস করছে।

ছেলের রেজাল্ট শুনে গফুর মিয়া আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ে। তার চোখের কোণে দুই ফোটা অশ্রু জমে। আধপাকা চুল, গোফ আর রোদে পোড়া মুখের রেখায় ছেলের রেজাল্টের সন্তুষ্টির চিহ্ন ভেসে উঠে। ওদিকে আমিনা পাশের বাড়িতে চলে যায় তার বান্ধবীদের খবরটা দিতে। আবেগাপ্লুত মনে গফুর মিয়া তখন ভাবতে থাকে তার স্ত্রীর কথা। ইশ! সে বেঁচে থাকলে আজ কত খুশিই না হতো। তার ছেলে আসিফ যখন ক্লাস সিক্সে পড়ে তখন তার স্ত্রী ব্রেইন টিউমারে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসার অভাবে মারা যায়। সেই থেকে গফুর স্বপ্ন দেখতে থাকে তার ছেলেকে সে ডাক্তার বানাবে। তাই ছেলে আর মেয়ের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে সে আর বিয়ে করেনি। তাই আজ এমন খুশির দিনে তার চোখে জল না এসে পারে?

নিজের চোখের সামনে যেদিন আসিফের মা বিনে চিকিৎসায় মারা যায় সেদিন থেকে আসিফও স্বপ্ন দেখে বড় ডাক্তার হবে এবং আর কোন মাকেই সে বিনে চিকিৎসায় মরতে দিবে না। চোখের সামনে মায়ের মৃত্যু আর বাবার হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম আসিফকে সবসময় তটস্ত রাখে। তাই বাবার স্বপ্ন পূরণে সে দিনরাত সমান তালে পড়াশুনা চালিয়ে যেতে থাকে। তার বাবার আর্থিক অবস্থা খারাপ এ নিয়ে তার কোন আক্ষেপ নেই, মনে কোন অভিমান নেই। তার লক্ষ্য একটাই সে ডাক্তার হয়ে বাবার স্বপ্ন পূরণ করবে এবং আর কোন মাকে বিনা চিকিৎসায় মরতে দিবে না।

রেজাল্ট পেয়ে গফুর মিয়া এলাকার মাতব্বরের বাড়ি যায় তার ছেলের রেজাল্টের কথা বলতে। মাতব্বর সাহেব প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। গফুর মিয়ার ছেলের রেজাল্টের কথা শুনে মাতব্বর গফুর মিয়াকে বুকে টেনে নেয় এবং চায়ের দোকান থেকে চা খাওয়ায়। এতে গফুর মিয়ার বুক ছেলের জন্য গর্বে ভরে উঠে। মাতব্বর বলেন-

-শুন গফুর, তোমাকে একটা কথা বলি। এই ছেলেকে টাকা দিতে কখনো কার্পণ্য করোনা। এই ছেলে এলাকার ভবিষ্যৎ। তুমি যদি একা খরচাপাতি না দিতে পার সমস্যা নাই আমরা তো আছি।

-হুজুর আপনারাই তো আমাদের সব। আপনারা ছাড়া আর কে আছে আমাদের বলেন?

এভাবে কথাবার্তা শেষ হলে সে বাড়ি ফিরে আসে এবং ভাবতে থাকে কিভাবে ছেলের জন্য টাকা জোগাড় করবে। কয়েক মাস আগে সে কারো কাছে শুনেছিল ডাক্তারি পড়াতে প্রায় ৫ লক্ষ টাকা লাগবে। এত টাকা সে কিভাবে সংগ্রহ করবে এ নিয়ে গফুর মিয়া চিন্তায় পরে যায়।

এভাবে মেডিকেল এডমিশনের দিন এলো। আসিফ বাবার আর্থিক দিক বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেয় বাড়িতেই বই কিনে প্রিপারেশন নিবে এবং সে অনুযায়ী সে প্রিপারেশন নেয়। যদিও বাহিরে গিয়ে কোচিং-এ ভর্তি হতে তার বাবার কোন বাধা ছিল না।

সে গ্রাম থেকে ঢাকা এলো পরীক্ষা দিতে। অচেনা নগরী, অচেনা মানুষ, অচেনা পরিবেশ। রাত এগারটায় সে তার পরীক্ষার কেন্দ্রের নিকট পৌছে। পরদিন ১০টায় এডমিশন। থাকার মত কোন জায়গা না থাকায় সে মসজিদের বারান্দায় বসে, শুয়ে রাত্রি যাপন করে। পরীক্ষা শেষ হল, সেও বাড়ি চলে আসে। তিন দিন পর রেজাল্ট দিল আসিফ ঢাকা মেডিকেল কলেজে টিকেছে। এখন শুধু টাকা দিয়ে ভর্তি হতে পারলেই সে তার বাবার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে পারবে। ইউনিয়ন পরিষদের তথ্যকেন্দ্র অফিস থেকে এই মহা খুশির খবর নিয়ে আসিফ তার বাবার কাছে যায়। তার বাবা এই সংবাদ শুনে খুশিতে আত্নহারা হয়ে যায়। গফুর যতটা খুশি হয়, তার চেয়ে বেশি চিন্তিত হয় এ কারণে যে সে কিভাবে এত টাকা জোগাড় করবে। মুহূর্তেই পুরো এলাকায় এই খবর ছড়িয়ে পড়ে। সবার মুখেই গফুর মিয়ার জয়, গফুর মিয়ার ছেলের জয়। টাকা পয়সার ব্যাপারে আলাপ করতে গফুর মাতব্বরের নিকট যায়। মাতব্বর গফুরকে আশ্বস্ত করে বলেন -

প্রয়োজনে গ্রামের সকল ঘর থেকে চাঁদা তুলে আমি তোমার ছেলের খরচ দিব। তুমি কোন চিন্তা করোনা গফুর। গফুর আশ্বস্ত হয়ে বাড়ি ফিরে।

রাতে খাবার শেষে গফুর ঘুমোতে যায়। কিন্তু ঘুম আসে না খুশিতে। নানা রকম চিন্তা তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। হঠাৎ সে উপলব্ধি করে, আমি এক সম্মানিত ছেলের বাবা। ছেলের কারণে আজ আমাকে এলাকার সকল মানুষ কত মূল্যই না দেয়।এমন কি মাতব্বররাও!

এমন সম্মানিত ছেলেকে কি সাহায্য তুলে পড়িয়ে অসম্মানিত করা ঠিক হবে? না কখনোই না, এটা ঠিক হবেনা। তার মন থেকে সিদ্ধান্ত আসে। সে সিদ্ধান্ত নেয় তার যে বিঘাটেক জমি ছিল তা বিক্রি করে দিবে। সম্পত্তি বলতে গফুরের এই জমিটি এবং গাভীটিই রয়েছে। তবু এই জমির জন্য তার কোন আক্ষেপ নেই। তার ছেলে যদি ডাক্তার হয় তাহলে তার সব কষ্ট দূর হয়ে যাবে। তার একটাই চাওয়া ছেলেকে সে ডাক্তার বানাবেই। এজন্য দরকার হলে মাথাগোঁজার ঠাই পৈতৃক ভিটাও বিক্রি করতে সে প্রস্তুত।

যেমন ভাবা, তেমনি কাজ। গফুর তার জমি বিক্রি করে দেয়। কাল আসিফ ভর্তি হতে যাবে। তাই তার বাবাকে টাকার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। তার বাবা তাকে কত টাকা লাগবে জিজ্ঞেস করলে সে উত্তর দেয় এখন প্রায় ৩০ হাজার টাকা লাগবে সব কাজ শেষ করতে। গফুর তার ছেলেকে বলে-সমস্যা নাই টাকা রাখা আছে। সকালে নিয়ে যেও। বাবার কথা শুনে আসিফ একটু অবাক হয়। কিভাবে তার বাবা এতটাকা যোগাড় করল! যাহোক টাকা ম্যানেজ হয়ে গেছে সুতরাং আসিফের আর কিছু জানার প্রয়োজন নেই। কারণ সে খুবই অল্প করে কথা বলে।

সকাল বেলা তার বাবা তাকে টাকার একটা বান্ডিল দিয়ে বলে এখানে এক লাখ ৫০ হাজার টাকা আছে। টাকার চিন্তা করোনা। পরে যখন লাগবে তখন এক সপ্তাহ আগে খবর দিও।

বাবা এবং বোনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আসিফ চলে আসে রাজধানীতে। ভর্তির কাজ সম্পন্ন করে সে একটা মেসে উঠে যায়। ইট, কাঠ, পাথরের এই শহর তাকে কত বাস্তবতাই না শিখিয়েছে। কিন্তু কোন কিছুই তাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। সে পড়াশুনা চালিয়ে যায় ঠিকভাবে। এক পর্যায়ে সে এক বড় ভাইকে বলে টিউশনি শুরু করে। ঢাকায় মেডিকেলের স্টুডেন্টদের ডিমান্ড অনেক বেশি। তাই সে মাত্র এক বছরের মধ্যেই তার বাবার জমিটি ফিরিয়ে দিয়েছিল। এতে তার বাবা অনেক খুশি হয়েছিল। কারণ এটাই ছিল গফুরের একমাত্র সম্বল, তাও আবার তার পিতার একমাত্র শেষ চিহ্ন।

গফুর আগের মতই কৃষক হিসেবে, দিনমজুর হিসেবে কাজ করতে থাকে। এভাবে হাজারো টানাপোড়নের মধ্যে আসিফের চার বছর মেয়াদি ডাক্তারি পড়া শেষ হয়। এতে গফুর একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। এখন শুধু বিসিএস পরীক্ষা পাস করতে পারলেই তার বাবার স্বপ্ন পূরণ হবে। সে ডাক্তার হয়ে সরকারি হাসপাতালে মানুষের সেবা করতে পারবে। গফুরও খুব আনন্দের সাথে সে দিনটির জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। অবশেষে বিসিএস পরীক্ষা হলো। অনেকদিন আসিফের বাড়ি যাওয়া হয় না। তাই পরীক্ষা দিয়েই সে বাড়ি যায় এবং খবরটা তার বাবাকে দিয়েই সে চলে আসে। প্রচুর পড়াশুনার মাধ্যমে আসিফের দিনগুলো কাটতে থাকে। ফেব্রুয়ারির ২ তারিখ তার ভাইবা। এক সপ্তাহ আগেই সে বাড়িতে চিঠি দিয়ে জানিয়ে দিয়েছে। ভাইবা মোটামুটি ভালই দিয়েছে সে। তবু মনে একটা ভয় সে টিকবে কিনা। যাহোক ভাইবা শেষ হওয়াতে কোন কাজ না থাকায় আসিফ সেদিনই বাড়ি ফিরে আসে। এসে দেখে তার বাবা যক্ষ্মারোগে আক্রান্ত হয়ে এক সপ্তাহ যাবৎ বিছানায় পরে আছে। প্রায় মৃত্যুপথযাত্রী সে। টানা পাঁচ বছর পরিশ্রম শেষে আসিফ বাড়ি ফিরেছিল একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে বলে। কিন্তু তার বাবার শারিরীক অবস্থা তাকে আরও অস্থির করে তোলে।

যাহোক দুই ভাই বোনের যত্নে আসিফের পিতা একটু সুস্থ্য হয়ে উঠেছিলেন। মার্চ মাসের ৩ তারিখে ভাইবার রেজাল্ট দিবে। তাই আসিফের ভিতর একধরনের উত্তেজনা কাজ করে। আর মাত্র ৩দিন বাকী রেজাল্টের। আসিফের বাবা মোটামুটি সুস্থ্য হয়ে উঠছেন। কিন্তু ২ মার্চ রাতে হঠাৎ করে আসিফের বাবা পরলোক গমণ করেন। সকালে সমগ্র এলাকায় খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। আসিফ এবং তার বোনের কান্নায় সুন্দরপুর গ্রামের বাতাস ভারী হয়ে উঠে। দাফন কাফন সেদিনই শেষ হয়। ৩ তারিখ আসিফ জুমার নামায শেষে বাবার কবর জিয়ারত করে যখন ফিরছিল তখন তার বাল্যকালের একবন্ধু খবর নিয়ে আসে আসিফ বিসিএস পাস করে সরকারি ডাক্তার হয়েছে। বন্ধুর মুখে খবর শুনেই আসিফের চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠে। এক পর্যায়ে সে বন্ধুর কাঁধে মাথা রেখে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে শুরু করে এবং বলতে থাকে "বাবা যদি আর একটা মাত্র দিন বাঁচত তাহলে তার শেষ স্বপ্নটা সফল দেখতে পারত।" এ বলে সে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে।এ কান্না কোন স্বজন হারানোর কান্না নয়, এ কান্না বুকের গভীরে লালিত হাজার বছরের স্বপ্ন ভঙ্গের কান্না।

লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সাভিয়ানগর, অষ্টগ্রামের কৃতি ছাত্র।

1 Comments


Warning: Undefined array key "datetime" in /home/vatirrani/public_html/comments.php on line 23
anayey ulllah rana
৬:০০ পূর্বাহ্ন, ১ জানুয়ারী, ১৯৭০
fantastic writing. we are for him.

Post Your Comment

সম্পাদক: গোলাম রসূল, উপদেষ্টা সম্পাদক: কুদ্দুস আফ্রাদ ও ইব্রাহিম খলিল খোকন, নির্বাহী সম্পাদক: এস. এম. ফরহাদ
বার্তাকক্ষ: 01911214995, E-mail: info@vatirrani.com
Developed by CHAHIDA.COM