সোমবার, ২০ মে ২০২৪
 
vatirrani News

মা

এক রোহিঙ্গা মায়ের সংগ্রামী জীবন নির্ভর ছোট গল্প

খাইরুল ইসলাম | ১০:৪৩ পূর্বাহ্ন, ২৮ ডিসেম্বর, ২০১৭

1514436237.jpg
খাইরুল ইসলাম

ভোর পাঁচটা, টিপটিপ বৃষ্টি হচ্চে,সাথে বজ্রের ঝলকানি। এমনি সময়ে সারারাত ব্যথায় কাতর নূরজাহান বেগম জ্ঞান হারালো। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার জ্ঞান ফিরে ছোট একটা চিৎকারে। চোখ খুলেই দেখে তার কোল আলো করে ১০ মাস ১০দিন গর্ভজাত সন্তান জন্ম গ্রহণ করেছে। বাড়ির মুরুব্বি মহিলা হানিফের মা বলছে, কিলো আর কত শুয়ে থাকবি? দেখ তোর ঘর উজ্জল করে কেমন রাজপুত্র এসেছে।দেখ কি ফুটফুটে চেহারা, একেবারে বাবার মত দেখতে। নূরজাহান তার চোখ দুটো আস্তে আস্তে খুলে,ছেলেকে দেখেই তার মুখে তৃপ্তির হাসি,যদিও ব্যথায় টনটন করছে কোমড়টা। সে সব ব্যথা ভুলে যায় যখন তার ছেলেকে কোলে নেয়।

যেই তার ছেলে ভূমিষ্ঠ হলো তখন থেকে যেন তার আর ব্যস্ততার অন্ত নেই।ছেলেকে নিয়ে কত কল্পনার জালই না সে বুনছে! আহা! ছেলে যে তার বড় সাধের ছেলে।পৃথিবীতে বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন।ছেলে তার বড় হয়ে চাকুরী করবে, বাবার নাম রাখবে, বুড়ি মাকে তখন এটা ওটা এনে দিবে। ভাবতেই যেন সে খুশিতে গদগদে হয়ে উঠে। এমন সোনার ছেলের কি যত্নের অভাব হলে চলবে? মাও ঠিকমত তার ছেলের দেখাশুনা করে।কখন যে দিন চলে যায় কিছুই টের পাওয়া যায় না। সামনে প্লেটের মধ্যে ভাত দেওয়া হয়ে থাকে কিন্তু নূরজাহান খাওয়ার কথাই ভুলে যায়। খাবার দখল করে মশা মাছি।

মা তার ছেলকে নিয়েই ব্যস্ত। মায়ের নতুন পৃথিবী তার ছেলে। তাই তো তার কখনো নাকের ডগা আর নরম কোমল গালের স্পর্শে পরম আদরে ছেলেকে ধন্য করে। ছেলে ও আদর পেয়ে খি খি হেসে উঠে। এইটুকু ছেলের হাসি দেখে মাও হেসে উঠে সহসা। কে না হেসে পারবে এমন লক্ষ্মী ছেলের হাসি দেখে? ওরে আমার সোনা মানিক রে, আমার জাদুরে এভাবে হাসতে নেই বাবা। মানুষ যে চোখ লাগিয়ে দিবে। এই বলে এই টুকুন ছেলেকে সে শাসন করে। কিন্তু দুষ্টু ছেলে কি সে কথা শুনে? ছেলে তার আরও জোড়ে হেসে উঠে। তারপর নিজেই নিজের ছেলের গায়ে হালকা থু থু ছিটিয়ে দেয় এই ভয়ে যে যদি চোখ লেগে যায়! (এখানে চোখ লাগা আর থু থু দেওয়া গ্রাম্য মহিলাদের মধ্যে চলমান একটা কুসংস্কার)।

এভাবে ২ মাস কেটে যায়।ছেলের নাম রাখা হয়েছে জয়।যেন সবকিছুই জয় করে ছাড়বে। শুধু কি জয়? আরও কত নাম আছে খোকা, মানিক, নকুল মুখে যা আসে যা শুনতে ভাল তাই বলেই সে তার ছেলেকে ডাকে। কলিজার টুকরা ছেলে তার। এক টা নামে হয় কি করে? ছেলে তার কয়েকদিন পর দৌড়াদৌড়ি করবে, এটা ওটা নিয়ে দুষ্টুমি করবে। আর যখন ভয় পাবে তখন মাকে এসে জড়িয়ে ধরবে।ইশ! কি ভালই না লাগে ভাবতে। এভাবেই সতরঞ্জিত স্বপ্ন আর মজার সব অনুভূতি নিয়ে তার দিন কাটে। তাই নূরজাহানের খেতে হয়না, ঘুমাতে হয়না। শুধু ছেলেকে আদর করতে পারলেই যেন তার আত্না শান্তি হয়। রাত ২টা বাজে। নূরজাহান ঢুলুঢুলে চোখে ঝিমাচ্ছে তার ছেলেকে কোলে নিয়ে।ছেলের গলার একটু শব্দ শুনেই সে সে চমকে উঠে। তারপর নড়েচড়ে বসে,ছেলে আবার আরামে ঘুমায়,মায়ের স্তন চুষতে চুষতে।এভাবেই কাটে তার রাতদিন ক্লান্তিহীন।

কোনদিন দুপুরবেলা যখন মা গোসল করে এসে দেখে ছেলের ঘুম এখনো ভাঙ্গেনি তখন সে ভয় পেয়ে যায়। বুকের ভিতরটা চনৎ করে উঠে। তাই মা ছেলের নাকের কাছে তার নরম গাল লাগিয়ে ছেলের শ্বাস প্রশাস অনুভব করে শান্ত হয়। ভেজা চুল শুকিয়ে যখন ভাতের প্লেট হাতে নিয়ে প্রথম লোকমাটা মুখে তুলে দেয় ঠিক তখনই তার বীর সন্তান বীরের মত গর্জন করে ঘুম থেকে উঠে বিছানা নষ্ট করে দেয়। মায়ের কি তখন আর হুশ থাকে?মা তখন খাবার প্লেট রেখেই ছেলের বিছানা পাল্টিয়ে ছেলের উদর পূর্তিতে ব্যস্ত হয়ে পরে।কারণ মা তো মা ই। মায়ের কি তুলনা চলে জগতে? এভাবেই আমাদের মা দের দিন গুলো কাটে আমাদের কে পরম আদর স্নেহ বিলিয়ে দেওয়া মাধ্যমে। সত্যি পৃথিবীতে মায়ের তুলনা কারো সাথেই হয় না।

এভাবে দিনগুলো কাটতে থাকে নূরজাহানের অসীম ভাল লাগার মধ্য দিয়ে। এমনই একদিন দুপুরবেলায় তার ছেলে হাত পা ছুড়ে খেলা করছিল। নূরজাহান তখন ভেজাচুল শুকাতে তোয়ালে পেচিয়েছে।হঠাৎ বিকট একটা শব্দ!তারপর শ্মশানের নীরবতা। একটি দাড় কাকের কা কা, তারপর অনেক গুলো পাখির কিচির মিচির, উড়ে যাওয়ার শব্দ। তারপরই মানুষের আর্ত চিৎকার! এর পর একই ধরনের আরও অনেক গুলো শব্দ। ওদিকে নূরজাহান তার পরম আদরের ছেলেকে বুকে জড়িয়ে আছে শক্ত করে।শব্দ গুলো থামছেনা। তাই মা ছেলের নিরাপত্তার আশঙ্কায় মাচাঙের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে দরজা লাগিয়ে দেয়। মাচাঙের জানালার ফাক দিয়ে বাহিরে তাকাতেই তার বুক শিউরে উঠে,শরীরের লোম দাড়িয়ে যায়।আবার সেনাবাহিনী!!! সেনাবাহিনী এলোথপাথারি গুলি বর্ষণ করছে।রাস্তায় যাকে পাচ্ছে তাকেই গুলি করে হত্যা করছে। এমন কি ঘর থেকে ধরে এনে পুরুষ, মহিলা, শিশুদেরকে ফায়ারিং স্কোয়াডে দাড় করিয়ে দিচ্ছে। মানুষ যে যার মত করে পালাচ্ছে। কেউ বুলেট খেয়েও না মরলে তাকে আবার বেয়োনেট দিয়ে খুচানো হচ্চে। অসহ্য যন্ত্রণা দিয়ে হত্যা করছে মানুষকে। তখন সে ভাবতে থাকে সেনাবাহিনী মানুষ মারবে কেন? এরা তো দেশের মানুষের নিরাপত্তা বিধান করবে। এমন সময় তার ঘরের দরজায় বুটের লাথি। দরজা খুলে ভিতরে ঢুকেই নূরজাহানের মা এবং তার ৮ বছরের ছোট ভাইটিকে গুলি করে হত্যা করে। এ দৃশ্য দেখে সে পাথর হয়ে যায়। কিন্তু ছেলেকে সে ঠিকই বুকে আগলে রাখে। তার সামনে তার পৃথিবীটা কাচের মত ভেঙ্গেচুড়ে যায়। সে শুধু নির্বাক তাকিয়ে থাকে। প্রায় ১ ঘণ্টা পর রোহিঙ্গা গ্রামটির অত্যাচার বন্ধ হয়। সেনাবাহিনী চলে যায় অন্য গ্রামে রোহিঙ্গা নিধন চালাতে। রাত ২টা তখন গ্রামের প্রায় সবাই বাড়ি ফিরে এসে গ্রাম ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। হানিফের মা তখন নূরজাহান কে বলল তাদের সাথে গ্রাম ছাড়তে। কিন্তু কে চায় তার পৈতৃক ভিটা ছাড়তে? অনিচ্ছা সত্ত্বেও ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে সে গ্রাম ছাড়ছে। এখন ছোট্ট ছেলেটি ছাড়া নূরজাহানের আর কেউ নেই। সে যখন আট মাসের অত্নসত্বা তখনই তার স্বামী সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। তার জিবন টাই যেন একটা ট্রাজেডি। একের পর এক বড় বড় আঘাত তাকে শেষ করে দিচ্ছে। বাল্য বিবাহের স্বীকার নূরজাহান তার ছেলেকে নিয়ে ঘর ছাড়ে সাথে মূল্যবান ধাতু, টাকা পয়সা আর সামান্য চিড়ে গুড় নিয়ে। কিছুক্ষণ পর ফজরের আযান পড়ে। ধান ক্ষেতের আইল দিয়ে নদীর পাড় যাওয়ার সময় যখন পেছনে তাকায় তখন দেখে গ্রামে আগুন দেওয়া হয়েছে। মানুষ আগের মতই ছুটাছুটি করছে যারা অবশিষ্ঠ ছিল।

নূরজাহানের কাদা পানিতে একাকার হয়ে গেছে এক কাপড় সম্বল তাই আর পাল্টানো যাবেনা। তার যাত্রা সঙ্গী হানিফের মায়ের কাছে পরম আদরের ছেলেকে দিয়ে কাদা পরিষ্কার করে আবার হাটতে থাকে। যাত্রা চলে তিন দিন। উদ্দেশ্যহীন যাত্রা, যেন যাযাবরদের জীবন। তার শরীরে কোন ক্লান্তি নেই, মনেও প্রচন্ড জোড়। মনে হয় একটা পাহাড় সে এক আঘাতে ভেঙ্গে ফেলতে পারবে। "কারণ বিপদ মানুষকে সংগ্রামী করে গড়ে তোলে।"নূরজাহানের ক্ষেত্রে ও তাই হলো।

চতুর্থ দিনে সে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। নদীর পাড়ের ঠান্ডা বাতাস আবার বৃষ্টিতে জ্বড় আসে নূরজাহানের। তবু তার চলাফেরা স্বাভাবিক। ছেলের যত্নের অভাব হয়না।ছেলেকে ঠিকই সে পরম আদরে রেখেছে।বুঝতেই দেয়নি যে এত ঝড় তার মায়ের উপর দিয়ে যাচ্চে। ৫ম দিনে নূরজাহান রা নাফ নদীর সীমান্তে পৌছে। এখানে এসে জানতে পারে সে বাংলাদেশ যাচ্চে। বাংলাদেশের মানুষ নাকি অনেক ভাল। এখানে নাকি সেনাবাহিনী কাউকে গুলি করে হত্যা করেনা। মানুষ খাবারের অভাবেও নাকি মারা যায় না। বাংলাদেশের মানুষ নাকি খুব অতিথি পরায়ণ। তাই এখানে আসতে পাড়লে আর কোন ভয় নাই। তাই বুকে বড় আশা আর ছেলের জন্য অকৃত্রিম ভালবাসা নিয়ে বাংলাদেশ যাবে।

অসহায় মা তার ছেলেকে ঠিকই আদর যত্নে রাখছে। তবু নদীর ঠান্ডা বাতাসে কবে যে তার ছেলের নিউমোনিয়া হয়েছে তা টের ও পায়নি। টের পাবেই বা কি করে?মা যে নতুন মা! প্রথম সন্তানের জননী। তার কি আর এত কিছু খেয়াল থাকে? সে ট্রলারে উঠে ছেলেকে সাথে নিয়ে বাংলাদেশে আসবে বলে। কিন্তু আবহা্ওয়া বেশি ভাল ছিলনা। তবু বড় আশায় বুক বেধে তার ছেলেকে নিয়ে বংলাদেশ আসছে। সে যখন টেকনাফ সীমান্তে পৌছেছে তখন তার মনে হচ্ছিল বিশুদ্ধ বাতাসে হৃদপিন্ড ভরে গেছে। তার সব চিন্তা নিমিষেই দূর হয়ে যায়। এখন শুধু ভালই ভালই একটা গ্রামে গিয়ে বৃষ্টি আসার আগে উঠতে পারলেই হয়। এদিকে তার ছেলের অবস্থা যায় যায়।প্রতিটি শ্বাসেই বুকের পাজর ভাঙ্গছে। নাক দিয়ে শ্বাস নিতে পারছেনা, তাই মুখ দিয়ে হা করে শ্বাস নিচ্চে। কিন্তু এত কিছু কি এমন চরম বিপদে খেয়াল করা যায়? কারন চরম বিপদ মানুষের পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের কার্যক্ষমতা হৃাস করে।এক ধরনের ঘুরের মধ্যে থাকে সে।

নৌকা থেকে নেমেই সে একরকম দৌড়ে হাটতে শুরু করে। মাঝে ছোট ছোট খাল পাড় হতে হয় তাকে ছেলেকে কোলে নিয়ে। কাদা পানিতে সে একাকার।কিন্তু ছেলেকে সে ঠিকই কাদা পানি থেকে নিরাপদ রাখে। এত জোড়ে হাটায় ছেলের গায়ে ব্যাথা লাগে তাই ছেলে কেঁদে উঠে মাঝে মধ্যে। তখন নূরজাহান ছেলেকে চুমোর পরম স্পর্শে শান্ত করার চেষ্টা করে। বলে এইতো বাবা এসে পড়েছি, আর একটু, আর একটু, এইতো শেষ, দেখ কতবড় হাসপাতাল, আর তোমার কিছু হবে না। এই বলে ছেলেকে চুমু দিতে থাকে। ছেলে ও শান্ত হয়। কান্না থেমে যায়। মা বেহুঁশ হয়ে পাগলের মত ছেলেকে চুমু দিতে দিতে একটা কমিউনিটি ক্লিনিক অবধি পৌছে বৃষ্টি নাগাল পাওয়ার আগেই। তার সাথের যাত্রীরা তখনও অর্ধ পথে। সে ছেলেকে চুমো দিতে দিতে নার্স কে বলল বোন আমার ছেলের ঠান্ডা একটু তাড়াতাড়ি দেখ। নার্স তখন নূরজাহানের দিকে অবাক হয়ে তাকায়। বাচ্চাটিকে কোলে নিয়ে নার্স হতবাক হয়ে যায়। কারণ বাচ্চাটি মরে শক্ত হয়ে আছে। তাই নার্স ঘোষণা দেয় বাচ্চাটি মৃত। সাথে সাথেই নূরজাহান স্তব্ধ হয়ে যায়। হাটু গেড়ে মাটিতে বসে পড়ে। ঝাপসা চোখে তার রঙিন স্বপ্ন গুলো কল্পনা করার চেষ্টা করে। কিন্তু তা আর হয়ে উঠে না।

লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সাভিয়ানগর, অষ্টগ্রামের কৃতি ছাত্র।

Post Your Comment

সম্পাদক: গোলাম রসূল, উপদেষ্টা সম্পাদক: কুদ্দুস আফ্রাদ ও ইব্রাহিম খলিল খোকন, নির্বাহী সম্পাদক: এস. এম. ফরহাদ
বার্তাকক্ষ: 01911214995, E-mail: info@vatirrani.com
Developed by CHAHIDA.COM