সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪
 
vatirrani News

প্রচ্ছদ স্বাস্থ্য কিশোরী ও নারীদের মাসিক স্বাস্থ্য পরিচর্চা ও চ্যালেঞ্জসমূহ

কিশোরী ও নারীদের মাসিক স্বাস্থ্য পরিচর্চা ও চ্যালেঞ্জসমূহ

স্বাস্থ্য ডেস্ক | ৬:২০ অপরাহ্ন, ১৫ জুলাই, ২০১৮

1531657226.jpg

কিশোরী ও নারীর জীবনে মাসিক একটি স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া; এটি মোটেই গোপনীয় বা লজ্জাজনক বিষয় নয়। বরং কোন মেয়ের প্রথম মাসিক হওয়ার দিনটি তার জন্য অনেক আনন্দের ও গর্বের, কেননা মাসিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই একটি মেয়ে নারীত্বের জন্য প্রস্তুতি লাভ করে। যা নারীর বৈশিষ্ট্য। 

ঋতুকালীন স্বাস্থ্য অধিকার সুরক্ষার বিষয়। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন চিত্র দেখায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ঋতুকালীন অবস্থায় নারীরা ঘর থেকে বের হওয়া বন্ধ করছে। নতুবা বিদ্যালয়ে যাওয়া বন্ধ করছে। পৃথিবী ব্যাপী কিশোরী ও নারী, যারা সবচেয়ে বৈষম্য পীড়িত, তাদের সঙ্গে তাই ঘটছে। এই সময়ের প্রেক্ষাপটেও কিশোরী ও নারী সমাজ বিচ্ছিন্ন হয়ে চার দেয়ালের আঁধারে বন্দি জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছে। সঠিক অব্যবস্থাপনার ফলে ক্ষুণ্ন হচ্ছে কিশোরী ও নারীদের মানবাধিকার।

একজন নারী তার সমগ্র জীবনের ৭ বছর সময় পার করে মাসিকের মধ্য দিয়ে। পৃথিবী ব্যাপী জনসংখ্যার ৫০ শতাংশ কিশোরী ও নারী যারা সাধারণত প্রতি ২৮ দিনে নিয়মিত একবার ঋতুচক্রের মধ্য দিয়ে যায়। স্বাভাবিক এবং প্রাকৃতিক এই প্রক্রিয়াটিকেই নানা রকম কুসংস্কার, গোঁড়ামি ইত্যাদি মাধ্যমে আড়াল করে রাখা হয় আমাদের এ দেশে। অসচেতনতা এবং সঠিক শিক্ষা ও ধারণার অভাবে প্রান্তিক পর্যায়ের কিশোরী ও নারীদের ঋতুকালীন ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত নাজুক অবস্থায় রয়েছে। বিশেষত কিশোরী ও নারীদের নানা দুঃসহ যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যেতে হয় ঋতুকালীন দিনগুলোতে। আমাদের মধ্যে যারা স্বাধীনভাবে চলাফেরা, পোশাক পরিধান এবং টয়লেট ব্যবহার করতে পারেন না বা সমস্যার মুখোমুখি হন, বিশেষত এদের মধ্যে আরও বৈষম্য পীড়িত বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী নারী, অটিস্টিক নারী, মনো-সামাজিক প্রতিবন্ধী নারী, ডাউনসিন্ড্রোম নারীদের ঋতুকালীন পরিচর্যা এবং যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকার, স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্য, পরিচ্ছন্ন থাকার পদ্ধতি বিষয়ে আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্র এখনো উদাসিন অবস্থানে রয়েছে এবং এখনও পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে পারেনি।

কিশোরী ও নারীদের ঋতুকালীন ব্যবস্থাপনা পরিপূর্ণ মর্যাদার সঙ্গে নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ২০১৬ সাল থেকে বাংলাদেশে নেদারল্যান্ডস এর দূতাবাসের অর্থায়নে ঋতু প্রকল্প মেয়েদের মাসিক স্বাস্থ্য ব্যাবস্থাপনা পরিস্থিতি উন্নয়নের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। ঋতু প্রকল্পে নেদারল্যান্ডস ভিত্তিক আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা সিমাভিলিড, রেড অরেঞ্জ মিডিয়া এন্ড কমিউনিকেশনস, স্ট্র্যাটেজিক এন্ড কমিউনিকেশন পার্টনার, নেদারল্যান্ডস ভিত্তিক গবেষণা সংস্থা টিএনও পার্টনার হিসেবে আছে। এছাড়াও মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়ন পার্টনার হিসেবে কাজ করছে ডিওআরপি এবং বিএনপিএস।

কিন্তু ঋতুকালীন কিশোরী ও নারীদের পরিপূর্ণ মর্যাদা দেওয়া হয় না সমাজে এবং তাদের সঠিক যত্নও নেয়া হয় না। নারীর ক্ষেত্রে নেতিবাচক কুসংস্কারাচ্ছন্ন দৃষ্টিভঙ্গি সমাজের যেমন রয়েছে তেমনি আমাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নে অনেকখানি পিছিয়ে থাকাও এ ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব রাখছে। যা আমাদের মানবাধিকার সুরক্ষা সহ শিক্ষা অধিকার, কাজের অধিকার, স্বাস্থ্য অধিকারকে ক্ষুণ্ন করে।

শুধু কিশোরী ও নারীই নয়, তৃতীয় লিঙ্গ নাগরিক যারা জন্মগত ভাবে নারী হিসেবে বেড়ে উঠেছে তাদের ঋতু পরিচর্যা ও যৌন স্বাস্থ্য বিষয়ে সামাজিক কাঠামো অত্যন্ত কঠোর। তাদের ঋতুকালীন স্বাস্থ্যসম্মত ব্যবস্থাপনা নিয়ে বেশ বাধার সম্মুখীন হতে হয়, বিশেষত রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্যসেবা ও সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তির অধিকার থেকে নিদারুণ ভাবে বঞ্চিত। সমাজের এই নেতিবাচক প্রভাবের কারণে তাদের ঋতুকালীন স্বাস্থ্য পরিচর্যা বাধার সম্মুখিন হয়। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে আদিবাসী, দলিত, জেলে, হরিজন, যৌনকর্মী ইত্যাদি সবাই কম-বেশি পিছিয়ে রয়েছেন। এই পিছিয়ে পড়ার পেছনে রাষ্ট্রীয়, সমাজ ও বাজার অর্থনীতির প্রভাব রয়েছে। আমাদের সমস্যা ও চাহিদাগুলো মেটাতে রাষ্ট্র খুবই উদাসীন এবং রাষ্ট্রের কোনো জবাবদিহিতাও নেই এ বিষয়ে। নিজ নিজ অধিকার প্রতিষ্ঠায় গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণের জন্য রয়েছে কাঠামোগত বাধা। আইন ও নীতি প্রণয়ন এবং পরিকল্পনা বাস্তবায়নের বিষয়ে নীতিনির্ধারকদের মধ্যে আগ্রহ দেখা যায় না যতটা তৈরিতে দেখা যায়।

স্বাস্থ্য অধিকারের সব বিষয় শিক্ষা অধিকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। জাতীয় পাঠ্যসূচিতে ঋতুকালীন ও প্রজনন স্বাস্থ্যবিধি-সম্পর্কিত সামান্য তথ্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যা কিশোরীদের স্বাস্থ্য অধিকার ও উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারছেনা। শিক্ষকগণও মাসিক বিষয়ে পাঠ্যদান করতে অনিচ্ছা ও দ্বিধা বোধ করেন। কিশোরীদের চাহিদার ভিন্নতার বিষয়গুলো পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করার ফলে বিদ্যালয়গুলো সঠিক দিকনির্দেশনা পাবে। এ ছাড়া ঋতুচক্র ও প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ে শিক্ষক-ছাত্রীদের মধ্যে কুসংস্কারমুক্ত আলোচনার পরিবেশ তৈরি হবে। বিদ্যালয় গুলোতে এই পরিবেশ মেয়েদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য অধিকার সচেতন করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

সঠিকভাবে ঋতুকালীন পরিচর্যায় স্বাস্থ্যসম্মত এবং ভালো মানের স্যানিটারি প্যাড, প্রবেশগম্য টয়লেট এবং পর্যাপ্ত পানির ব্যবস্থাসহ গোপনীয়তার সঙ্গে ঋতুকালীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশ সরকার ১৯৮৪ সালে নারীর সকল অধিকার প্রতিষ্ঠার সনদ সিডো অনুসমর্থন করে। এরপর আর নারীকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। সরকার নারীর সকল অধিকার বাস্তবায়নে জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি প্রণয়ন করেছে। মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা বিষয়ক নীতিমালা প্রণয়ন করার মাধ্যমে কিশোর ও নারীর মাসিক স্বাস্থ্যসেবা সুনিশ্চিত হবে বলে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।

কিশোরী ও নারীদের মাসিক স্বাস্থ্যসেবা সুনিশ্চিত করার লক্ষ্যে আমাদের কিছু প্রস্তাব তুলে ধরা হলো:

১) স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়, খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের বাজেটে কিশোরী ও নারীদের জন্য মাসিক স্বাস্থ্য সেবা খাতে বিশেষ বরাদ্দ প্রদান;

২) সরকারি এবং বেসরকারি পর্যায়ে ঋতুকালীন পরিচর্যা ও স্বাস্থ্যবিধি বিষয়ে সচেতনতামূলক কার্যক্রমে কিশোরী ও নারীদের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা;

৩) কিশোর ও নারীদের সমাজের মূলধারায় একীভূত রাখা এবং শিক্ষাসহ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা;

৪) ই ই সি আরের প্রকল্পের আওতাধীন এবং ইউনিসেফের সহযোগিতায় মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে প্রক্রিয়াধীন জাতীয় কিশোর-কিশোরী কৌশল ও কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী কিশোরীদের মাসিককালীন পরিচর্যা বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়া;

৫) দেশীয় কাঁচামাল, প্রযুক্তি ব্যবহার করে স্যানিটারি ন্যাপকিন তৈরির মাধ্যমে মূল্য কমিয়ে সকলের ক্রয় সীমার মধ্যে নিয়ে আসতে ভর্তুকির ব্যবস্থা করা;

৬) চাহিদার ওপর ভিত্তি করে বিশেষ ধরনের স্যানিটারি প্যাড তৈরিতে দেশীয় বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে উৎসাহিত করা;

৭) কিশোরী ও নারীদের মাসিককালীন পরিচর্যা এবং হাইজিন ব্যবস্থার ওপর বেইজলাইন স্টাডি ২০১৭ তে প্রতিবন্ধী কিশোরী ও নারীর বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করার ব্যবস্থা করা;

৮) মাসিককালীন অবস্থার বিভিন্ন ধরনের ট্রমা থেকে মুক্তি পেতে টেলিফোনিক কাউন্সেলিংকে উৎসাহিত করা এবং ভালো মানের স্যানিটারি প্যাড ব্যবহারে সচেতনতা বৃদ্ধি করা;

৯) বিদ্যালয়/কলেজ গুলোতে মাসিককালীন পরিচর্যার ব্যবস্থা সহ টয়লেট স্থাপনে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা এবং স্যানিটারি প্যাড প্রাপ্তি এবং ডিসপোজালের ব্যবস্থা করা;

১০) বিশেষায়িত বিদ্যালয় গুলোতে শিক্ষকদের এ বিষয়ে প্রশিক্ষণএবং পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা করা;

১১) তৃণমূল পর্যায়ে নারীদের তাদের স্বাস্থ্য ও সন্তান জন্মদান-সংক্রান্ত স্বাস্থ্য অধিকার বিষয়ে সচেতনতা ও ন্যাশনাল ট্রমা কাউন্সেলিং কার্যক্রম সেন্টারে মনো-সামাজিক কাউন্সেলিং বৃদ্ধি করা;

১২) ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ও অনগ্রসর নারীর উন্নয়ন ও বিকাশের সব অধিকার নিশ্চিত করা।

Post Your Comment

সম্পাদক: গোলাম রসূল, উপদেষ্টা সম্পাদক: কুদ্দুস আফ্রাদ ও ইব্রাহিম খলিল খোকন, নির্বাহী সম্পাদক: এস. এম. ফরহাদ
বার্তাকক্ষ: 01911214995, E-mail: info@vatirrani.com
Developed by CHAHIDA.COM